২৬ মার্চ কি দিবস তা সম্পর্কে জেনে নিন
১৬ ডিসেম্বর কি দিবস জেনে নিনআপনারা ২৬ শে মার্চ কি দিবস এই সম্পর্কে জানতে চাচ্ছেন? তাহলে আরো জেনে নিন ২৬ শে মার্চ কেন স্বাধীনতা দিবস, মুক্তিযুদ্ধের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, ২৬ মার্চ কি দিবস এবং ১৬ ডিসেম্বর কি দিবস সম্পর্কে ২৬ মার্চ কি দিবস আর্টিকেলটি পড়ার মাধ্যমে।
বাঙালির আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা ধরে রাখতে আমরা বদ্ধপরিকর। এই স্বাধীনতার ইতিহাস সম্পর্কে প্রত্যেককেই জানা আবশ্যক। চলুন, বাঙালির ইতিহাসের কথা জানতে ২৬ মার্চ কি দিবস আর্টিকেলটি মনোযোগ সহ পড়ুন।
২৬ শে মার্চ কেন স্বাধীনতা দিবস
২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবস তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না কেন ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবস। তাই আজ আমরা আপনাদের জানাতে এসেছি কেন ২৬ মার্চকে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তাছাড়া ২৬শে মার্চ সম্পর্কে আপনাদের কাছে কিছু অজানা তথ্য নিয়ে হাজির হয়েছি।এখন পর্যন্ত আমরা সবাই জানি যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস ২৬শে মার্চ পালিত হয়।
বাংলাদেশের সংগ্রাম শুরু হয় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে যখন পাকিস্তানিরা বাঙালিদের উপর বে-সরকারী গণহত্যা চালায় এবং ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন। এরপর মেজর জিয়াউর রহমানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষণা সবার কাছে পৌঁছে যায়।১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান পৃথক হওয়ার পর পাকিস্তান দুটি রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
একটি পূর্ব পাকিস্তান এবং অন্যটি পশ্চিম পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তান বর্তমান বাংলাদেশ। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে জাতিগত, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অধিকারগত পার্থক্য ছিল। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তাদের মধ্যে এই মতানৈক্য ছিল এবং বিভিন্ন পর্যায়ে ছোটখাটো সংঘর্ষ ও গণহত্যার ঘটনা ঘটে।
এই নির্যাতন ও গণহত্যা থেকে বাংলাদেশ তথা পূর্ব পাকিস্তানকে মুক্ত করার দাবি আদায়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ শীর্ষস্থানীয় নেতা-কর্মী ও শীর্ষ পেশাজীবীরা বিভিন্নভাবে প্রতিবাদ করেন। আর এই প্রতিবাদ যখন চরম পর্যায়ে পৌঁছে তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর কিছু সহ্য করতে না পেরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
এবং নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ৩০ লাখ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। তাই ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবসের মূল কারণ হলো পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদারদের হাত থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করা এবং স্বাধীনতা লাভ করা।
২৬ শে মার্চ এর সংক্ষিপ্ত বক্তব্য
আমার বক্তব্যর শুরুতে আমি মঞ্চের সামনে বসা মাননীয় প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি, সম্মানিত সুধীজনদের প্রতি আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাতে চাই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাখো প্রাণের দান, আমি প্রাণ দিয়ে দেশের স্বাধীনতার মান রক্ষা করব। আজ সেই মহান মানুষটিকে খুব মনে পড়ছে। যিনি পাকিস্তানি শাসনামলে ১২ বছরেরও বেশি সময় জেলে থাকা, একাধিকবার ফাঁসির মঞ্চের মুখোমুখি, অসংখ্য মিথ্যা মামলায় অসংখ্যবার কারা বরণ করেও এদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
তিনি হাজার বছরের বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যার অসীম সাহসিকতা, দৃঢ় মনোভাব ও আপসহীন নেতৃত্ব বাঙালি জাতিকে সংগ্রামে সাহস যুগিয়েছিলেন। সেই সাথে স্মরণ করছি, সেইসব শহীদদের প্রতি যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের আজকের এই স্বাধীনতা। প্রিয় উপস্থিতি আমরা সকলেই জানি যে, "স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা আরও কঠিন"।
তাই আমরা যদি স্বাধীনতার আশা এবং আত্মত্যাগকে রক্ষা করতে চাই, তবে আমাদের অবশ্যই আমাদের দেশকে ভালবাসতে হবে। এবং আমরা যেখানেই থাকি না কেন তার জন্য কাজ করতে হবে। আমরা যদি সৎ ও দুর্নীতিমুক্ত হই এবং আমাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করি তাহলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারবো ইনশাল্লাহ।
এই শুভদিন উপলক্ষ্যে, আমি আমাদের সমস্ত সশস্ত্র বাহিনী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং প্রত্যেক ব্যক্তিকে আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই যারা আমাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং আমাদের স্বাধীনতা রক্ষায় অক্লান্ত অবদান রেখেছেন। স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার ও ঐক্যের নীতি আমাদেরকে আরও উজ্জ্বল ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের দিকে পরিচালিত করুক। বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হোক! ধন্যবাদ।
২৬ মার্চ কি দিবস
২৬শে মার্চ কি দিবস - এই দিবস সম্পর্কে বলতে গেলে বলে শেষ করা যাবেনা। এ সম্পর্কে লিখতে গেলে কখন যে চোখে অশ্রু আসবে কল্পনাই করতে পারবেন না। ইতিহাসের পাতায় আজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবে এই দিনটি। কিন্তু বর্তমান জেনারেশনের অনেকের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান তাদের মাঝে নেই। যা আমরা জাতি হিসেবে লজ্জিত।
আজ ২৬ মার্চ দেশের ৫৩ তম মহান স্বাধীনতা দিবস ও জাতীয় দিবস। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ভোরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হানাদার বাহিনীকে সর্বশক্তি দিয়ে হানাদারদের প্রতিহত করার এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। এরপর ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
১৬ ডিসেম্বর কি দিবস
১৬ ডিসেম্বর হচ্ছে বাংলাদেশের বিজয় দিবস। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামে একটি নতুন স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। বাংলাদেশে প্রতি বছর দিবসটি যথাযোগ্য ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে পালিত হয়। ১৬ ডিসেম্বর ভোররাতে ৩১ বন্দুকের স্যালুটের মাধ্যমে দিনটি শুরু হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে কোনো কিছুর বর্ণনা করতে হলে একটু আগের সময়ের কথা বলতে হবে। ব্রিটিশরা প্রায় ২০০ বছর এই অঞ্চল শাসন করে। তাদের হাত থেকে মুক্তির জন্য হাজার হাজার মানুষ জীবন দিয়েছে, জেলে গেছে। ১৯৪০ সালে 'লাহোর রেজুলেশন'-এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতের দুটি অঞ্চল থেকে দুটি দেশ এবং অবশিষ্ট অঞ্চল থেকে একটি দেশ তৈরি করা হবে।
কিন্তু ১৯৪৭সালের ১৪ আগস্ট যে দুটি অঞ্চলে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সেগুলিকে ভাগ করে পাকিস্তান নামক একটি দেশে এবং ১৫ আগস্ট অবশিষ্ট অঞ্চল দুটি ভিন্ন দেশের পরিবর্তে ভারত নামক আরেকটি দেশে বিভক্ত হয়। পাকিস্তান নামে পৃথিবীতে একটি বড় দেশের জন্ম হয়েছিল।
যার দুটি জায়গায় দুটি অংশ রয়েছে। বর্তমানে যা পাকিস্তান তাকে বলা হয় পশ্চিম পাকিস্তান এবং বর্তমানে যেটি বাংলাদেশ তাকে বলা হয় পূর্ব পাকিস্তান। এর মধ্যে দূরত্ব প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার এবং একটি ভিন্ন দেশ রয়েছে - ভারত।
বৈষম্য, শোষণ,ষড়যন্ত্রঃ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে শুধু প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার দূরত্বই নয়, মানুষের মধ্যেও ছিল বিশাল দূরত্ব। তাদের চেহারা, ভাষা, খাদ্য, পোশাক, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য সবই আলাদা ছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মধ্যে একটাই কথা প্রচলিত ছিল- সেটা হল ধর্ম। এমন আজব দেশকে টিকিয়ে রাখার জন্য আরেকটু আলাদাভাবে চেষ্টা করা উচিত। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকরা সে চেষ্টা করেনি। দেশভাগের সময় পশ্চিম পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল দুই কোটি।
পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল চার কোটি। তাই সহজেই বলা যায় শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, পুলিশ-সামরিক, বেসামরিক কর্মচারীদের মধ্যে একজন পশ্চিম পাকিস্তানি থাকলেই হবে। আর ২ জন পূর্ব পাকিস্তানি হওয়া উচিত কিন্তু বাস্তবে হয় এর উল্টোটা। সব কিছুতেই পশ্চিম পাকিস্তানের অংশ ছিল ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ। বাজেটের ৭৫% পশ্চিম পাকিস্তানের আর ২৫% পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয় করা হয়েছিল।
যদিও পূর্ব পাকিস্তান থেকে রাজস্ব আয় বেশি ছিল যার পরিমাণ ৬২%। সবচেয়ে উদ্বেগজনক ছিল সেনাবাহিনীর আকার, পশ্চিম পাকিস্তানে পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় ২৫ গুণ বেশি সৈন্য ছিলো। এভাবেই দিনের পর দিন শোষিত বঞ্চিত হয় পূর্ব বাংলা।
ভাষা আন্দোলনঃ অর্থনৈতিক নিপীড়নের চেয়েও অনেক বড় নিপীড়ন হল একটি জাতির ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের নিপীড়ন। এবং ঠিক এটাই শুরু করেছিল পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী। পাকিস্তানের জন্ম ১৯৪৭ সালে এবং ঠিক ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে ঘোষণা করেন যে উর্দু হবে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা। তৎক্ষণাৎ পাকিস্তানের বাঙালিরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় এবং প্রতিবাদ শুরু করে।
আন্দোলন তীব্রতর হয় এবং ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। পুলিশের গুলিতে নিহত হন রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ আরও অনেকে। তারপরও আন্দোলন থামানো যায়নি, অবশেষে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের শাসক শ্রেণীকে বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দিতে হয়।
যেখানে আমাদের ভাষা শহীদরা প্রাণ দিয়েছেন, সেখানেই এখন আমাদের প্রিয় শহীদ মিনার, আর ২১শে ফেব্রুয়ারি শুধু বাংলাদেশের মাতৃভাষা দিবস নয় পুরো পৃথিবীর মানুষের জন্য আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
ছয় দফাঃ দেশে সামরিক শাসন, তার ওপরে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর এত বঞ্চনা। তাই বাঙালিরা খুব সহজে মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। বাঙালির সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের উজ্জ্বল নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জন্য স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে ৬ দফা ঘোষণা করেন। ছয় দফা ছিল সকল প্রকার অর্থনৈতিক শোষণ, বঞ্চনা ও নিপীড়ন থেকে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের মুক্তির এক উল্লেখযোগ্য দলিল।
তৎকালীন পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে যে অত্যাচার চলছিল তার মধ্যে ৬ দফা নিয়ে স্বায়ত্তশাসনের মতো দাবি তুলতে অনেক সাহসের দরকার ছিল। ৬ দফা দাবি জানানোর সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগের ছোট-বড় সব নেতাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। শুধু তাই নয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কঠিন শাস্তি দিতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় প্রধান আসামি করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা তা কিছুতেই মেনে নেয়নি এবং সারাদেশে আন্দোলন শুরু হয়।
জেল-জুলুম, পুলিশ, ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) গুলি, সবই ব্যবহার করেছিল। কিন্তু আন্দোলন থামানো গেল না। ছাত্ররা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল। তাদের ১১দফা দাবি ছিল। জেল থেকে বেরিয়ে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীও এগিয়ে আসেন। আন্দোলন যেভাবে গণবিস্ফোরণে পরিণত হয়েছে তাকে ঠেকাতে পারবে কে। ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনে কিশোর মতিউর জীবন দিয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আসাদ প্রাণ দিয়েছেন, যার নামানুসারে আইয়ুব গেটের নাম রাখা হয়েছে আসাদ গেট। পাকিস্তান সরকার অবশেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল নেতাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে ছেড়ে দেন ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট আয়ুর খান। তারিখটি ছিল ২৫ মার্চ ১৯৬৯ তার ঠিক দুই বছর পরে একই দিনে এই দেশের মাটিতে বিশ্বের অন্যতম জঘন্যতম গণহত্যা শুরু হবে।
প্রথম নির্বাচনঃ জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় আসার সাথে সাথে তিনি পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দেন। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তান জুড়ে প্রথম সাধারণ নির্বাচন খুব সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সিনিয়র জেনারেলদের কোনো সম্মান ছিল না। তারা ধরে নিয়েছিল যে নির্বাচনে কোনো একক রাজনৈতিক দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না।
দলগুলো নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করবে এবং সেনাবাহিনী অজুহাতে দেশের ক্ষমতা কেড়ে নেবে। তাই নির্বাচনের ফলাফল দেখে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে, ফলাফল ছিল অবিশ্বাস্য- বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২টি আসনের মধ্যে বিপুল ভোটে ১৬০টি আসনে জয়লাভ করে।
যখন সব আসনের নির্বাচন শেষ হয়, তখন দেখা যায় যে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ৩১৩টি আসনের মধ্যে মনোনীত মহিলা আসন সহ, আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে ১৬৭টি আসন জিতেছে। জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিপলস পার্টি পশ্চিম পাকিস্তানে ৮৮টি আসন জিতেছে। আর সব দল মিলে বাকি ৫৮টি আসন পেয়েছে। এই প্রথম পাকিস্তান সরাসরি পূর্ব পাকিস্তানের নেতাদের দ্বারা শাসিত হবে।
বঙ্গবন্ধু সাফ জানিয়ে দেন, ৬ দফার কথা বলে তিনি জনগণের ভোট পেয়েছেন। এবং তিনি ৬ দফার ভিত্তিতে সংবিধান লিখবেন ৬ দফার ভিত্তিতে দেশ পরিচালিত হবে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অবিলম্বে সিদ্ধান্ত নেয় যে পাকিস্তানের শাসন কোনো অবস্থাতেই বাঙালিদের হাতে তুলে দেওয়া যাবে না। অজান্তেই জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও তার দল 'বাংলাদেশ' নামে একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্মের প্রক্রিয়া শুরু করে।
ষড়যন্ত্র শুরুঃ জেনারেলদের ষড়যন্ত্রের সবচেয়ে বড় সহযোগী ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো। এক সময়ের সামরিক শাসক আইয়ুব খানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। হঠাৎ জুলফিকার আলী ভুট্টো জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে লারকানায় 'পাখি শিকারে' যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। পাকিস্তানের বাঘা বাঘা জেনারেল জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সাথে 'পাখি শিকারে' যোগ দেন। কীভাবে বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা না দেওয়া যায় সেই ষড়যন্ত্রের নীলনকশা সম্ভবত সেখানেই তৈরি হয়েছিল।
ভেতরে ভেতরে ষড়যন্ত্র চললেও জেনারেল ইয়াহিয়া খান বাইরে তা প্রকাশ করতে চাননি। তাই তিনি ১৩ ফেব্রুয়ারি ঘোষণা করেন যে ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে। সবাই অধীর আগ্রহে সেই দিনের জন্য অপেক্ষা করছিল। মাঝখানে ১৯৭১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালির ভালোবাসা আর মমতার শহিদ দিবস পালিত হয় অন্যরকম উন্মাদনায়। মানুষ সেদিন শহীদ মিনারে ভিড় করেছিল, স্বাধীনতার স্বপ্ন তাদের হৃদয়ে জন্ম নিতে শুরু করেছিল।
২১শে ফেব্রুয়ারি বাঙালির উন্মাদনা দেখে পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের মনে যে সন্দেহ ছিল তাও দূর হলো। জুলফিকার আলী ভুট্টো সংখ্যালঘু ছিলেন, ক্ষমতার ভাগ থাকার কথা ছিল না। কিন্তু তিনি ক্ষমতার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের মাত্র ২দিন আগে ১লা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেন। এতে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে ক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠল। যার ফলে সারাদেশে বিক্ষোভ শুরু হলো।
জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা হয়েছে, ঢাকা স্টেডিয়ামে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কমনওয়েলথ একাদশের খেলা চলাকালীন রেডিওতে ঘোষণা করা হয়েছিল। মুহূর্তের মধ্যেই উত্তাল হয়ে ওঠে জনতা, ঢাকা স্টেডিয়াম পরিণত হয় রণক্ষেত্র। স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, দোকানপাট-সবকিছুই বন্ধ ছিল। লাখ লাখ মানুষ রাজপথে নেমেছে, পুরো ঢাকা শহর পরিণত হয়েছে মিছিলের নগরীতে। মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হতে থাকে স্বাধীনতার স্লোগান: ‘জয় বাংলা’ ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’।
এই সময় বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন। দেশের আনাচে-কানাচে মিছিল বিক্ষোভ শুরু হল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে মারা যাচ্ছে অসংখ্য মানুষ তারপরও কেউ থেমে যায়নি। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় বাংলাদেশের মানচিত্র সম্বলিত স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। গত ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের জনসভায় জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে নির্বাচিত হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'আমার সোনার বাংলা' গানটি।
পাঁচ দিনের ধর্মঘটের পর ৭ই মার্চ বক্তৃতা দিতে বঙ্গবন্ধু বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আসেন। ততক্ষণে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান বঙ্গবন্ধুর বাণী অনুসরণ করছে। তার বক্তব্য শুনতে লাখো মানুষ ছুটে আসেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান জনসমুদ্র পরিণত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক ভাষণে ঘোষণা করেছিলেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ভাষণ খুব বেশি দেওয়া হয়নি।
এই ভাষণ সেদিন দেশের সকল মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতা সংগ্রামে জীবন উৎসর্গ করে দেশকে স্বাধীন করার শক্তি জোগায়। একদিকে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সারাদেশে যখন অসহযোগ আন্দোলন চলছে। অন্যদিকে দেশের আনাচে - কানাচে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর হাতে প্রতিদিন শত শত মানুষ নিহত হচ্ছে। ছাত্র-শ্রমিক-জনতা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর চলাচল ঠেকাতে পথে ব্যারিকেড তৈরি করছে।
সারাদেশে ঘরে ঘরে কালো পতাকা নিয়ে উড়ছে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। দেশের শিক্ষার্থীরা মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। মওলানা ভাসানী ৯ মার্চ পল্টন ময়দানে এক জনসভায় স্পষ্ট ঘোষণা দেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানিদের আলাদা করে তাদের নিজস্ব শাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। কারণ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ একটি স্বাধীন দেশের জন্ম দিয়ে তাদের নিজস্ব শাসনব্যবস্থা তৈরি করবে।
এ সময়ই জেনারেল ইয়াহিয়া খান গণহত্যার প্রস্তুতি শুরু করেন। বেলুচিস্তানের কসাই হিসেবে পরিচিত জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের কোনো বিচারক তাকে গভর্নর হিসেবে শপথ নিতে রাজি হননি। ইয়াহিয়া খান ১৫ মার্চ স্বয়ং ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনার ভান করতে লাগলেন, এর মধ্যে প্রতিদিন বিমানযোগে ঢাকায় সৈন্য আনা হচ্ছে।
যুদ্ধজাহাজে অস্ত্র এসে চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করলেও জনগণের বাধায় অস্ত্র খালাস করতে পারেনি। ভুট্টো ২১ মার্চ তড়িঘড়ি করে ঢাকায় এসে আলোচনার ভান করে ষড়যন্ত্রে যোগ দেন। ১৯ মার্চ জয়দেবপুরে বাঙালি সৈন্যরা বিদ্রোহ করে। তাদের ঠেকাতে ঢাকা থেকে পাঠানো সেনাবাহিনীর সঙ্গে সাধারণ মানুষের সংঘর্ষে বিপুল সংখ্যক মানুষ প্রাণ হারায়। ২৩শে মার্চ ছিল পাকিস্তান দিবস।
কিন্তু সেনাবাহিনীর সেনানিবাস ও সরকারি বাড়ি ছাড়া বাংলাদেশের কোথাও কোনো পাকিস্তানি পতাকা দেখা যায়নি। ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে সেদিন ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের সঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। পরের দিন ২৪ মার্চ সারাদেশে একটা নিস্তব্ধ পরিবেশ ছিল, যেন এদেশের মাটি, আকাশ-বাতাস ইতিমধ্যেই গণহত্যার খবর জেনে নিঃশ্বাসে অপেক্ষা করছে।
২৫ মার্চ রাতে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ দিয়ে সন্ধ্যার দিকে পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খান সেনাবাহিনীকে বলেছিলেন, ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করো, তাহলে তারা আমাদের হাত চাটবে! গণহত্যার অনেক আগে থেকেই পরিকল্পনা করা হয়েছে, অপারেশন সার্চলাইট, তাতে স্পষ্ট বলা আছে কীভাবে আলোচনার ভান করতে দেরি করা যায়।
কীভাবে বাঙালি সৈন্যদের নিশ্চিহ্ন করা যায়, কীভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আক্রমণ করা যায়, সংক্ষেপে, কীভাবে একটি জাতিকে ধ্বংস করার প্রক্রিয়া হবে। শহরের প্রতিটি রাস্তায় ব্যারিকেড করা হয়েছে যেন লক্ষ্যে পৌঁছাতে দেরি হয়। তাই রাত ১১ঃ৩০ টায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইট শুরু করে নির্ধারিত সময়ের আগেই। বিশ্বের জঘন্যতম গণহত্যা শুরু হয়, সমস্ত বিদেশী সাংবাদিকদের দেশ থেকে বহিষ্কার করা হয় যাতে এই হত্যাযজ্ঞের কোনো সাক্ষী না থাকে।
তার পরও সাইমন ড্রিং নামের একজন অত্যন্ত সাহসী সাংবাদিক নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকা শহরে আত্মগোপন করে ওয়াশিংটন পোস্টের মাধ্যমে এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের কথা সারা বিশ্বকে জানান। ঢাকা শহরের নিরীহ জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী সাধারণ সৈন্যদের নিরস্ত্র করে। বাঙ্গালী অফিসারদের হত্যা এবং গ্রেফতার করে। পিলখানায় ই.পি. আরদারদেরও নিরস্ত্র করা হয়েছিল।
কিন্তু তারা যা করতে পেরেছিল তা দিয়ে রাতভর যুদ্ধ করেছিল। রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পুলিশকে নিরস্ত্র করা যায়নি এবং পুলিশ বাহিনীই প্রথম পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে প্রকৃত যুদ্ধ শুরু করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে পিছু হটে এবং ট্যাংক, মর্টার, ভারী অস্ত্র, মেশিনগান দিয়ে পাল্টা আক্রমণ করে এবং অবশেষে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের নিয়ন্ত্রণ নেয়।
২৫ মার্চের ভয়াবহতার শেষ নেই। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ইকবাল হল (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ও জগন্নাথ হলের সকল ছাত্রকে হত্যা করে। তাদের হত্যার আগে জগন্নাথ হলের সামনে একটি গর্ত খনন করা হয়েছিল, যেখানে তাদের মৃতদেহ সমাহিত করা হয়েছিল। এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য, যা বুয়েটের অধ্যাপক নূর উল্লাহ তার বাসা থেকে তৈরি করতে পেরেছিলেন।
তা এখন ইন্টারনেটে মুক্তিযুদ্ধের আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে, বিশ্ববাসী চাইলে নিজ চোখে দেখতে পারে। তারা শুধু ছাত্রদের নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ কর্মচারী এমনকি শিক্ষকদেরও হত্যা করেছে। পাশের বস্তি পুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং মেশিনগানের গুলিতে অসহায় মানুষ মারা যায়। এরপর তারা পুরান ঢাকার হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় হামলা চালায়, মন্দির গুড়িয়ে দেয়, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়।
যারা পালানোর চেষ্টা করেছিল তাদের সবাইকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী গুলি করে হত্যা করেছিল। ২৫ মার্চ ঢাকা শহর ছিল আগুনের মতো, সর্বত্র আগুন আর শিখা, গুলির শব্দ আর মানুষের আর্তনাদ।অপারেশন সার্চলাইটের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা। আগেই খবর পেয়ে তিনি তার দলের সকল নেতাকে প্রত্যাহার করার নির্দেশ দেন এবং নিশ্চিত মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে বসেন।
বাংলাদেশ স্বাধীনঃ কমান্ডো বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে বন্দী করার আগে তিনি বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে ঘোষণা করেন। সেই ঘোষণায় তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার আহ্বান জানান। তার ঘোষণা তৎকালীন ইপিআরের ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। যখন ঘোষণাটি করা হয়েছিল তখন ২৬ মার্চ মধ্যরাত বেজে গেছে, তাই আমাদের স্বাধীনতা দিবস ২৬মার্চ।
পূর্ব পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র পৃথিবীর মানচিত্র থেকে চিরতরে মুছে যায়, জন্ম নেয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। কিন্তু সেই বাংলাদেশ এখনো বেদনাদায়ক, বেদনাদায়ক। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এখনও তার মাটিতে রয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এদেশের মানুষের হৃদয়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত করলেও স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যে ব্যক্তি এই সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি ৩০ মার্চ পরিবারকে রেখে সীমান্ত অতিক্রম করেছিলেন। তখন তার সাথে আর কোন নেতা ছিলেন না, পরে তিনি সবার সাথে যোগাযোগ করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করেন। ১০ এপ্রিল মুজিবনগর থেকে ঘোষণা করা হয় ঐতিহাসিক স্বাধীনতার সনদ।
এই সনদের মাধ্যমেই বাংলাদেশ নৈতিক ও আইনগতভাবে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এই নতুন রাষ্ট্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে উপরাষ্ট্রপতি ও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে (মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা) বাংলাদেশের প্রথম সরকার দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের সামনে শপথ গ্রহণ করে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। তাদের প্রথম দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশের মাটিতে থাকা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করা।
যৌথ বাহিনীঃ জুলাই মাসে নতুন যুদ্ধ শুরু করার পর অক্টোবরে বাংলাদেশ লিবারেশন আর্মি আরও শক্তিশালী ও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। তারা নিয়মিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সীমান্ত ঘাঁটি আক্রমণ ও দখল করতে থাকে। গেরিলা আক্রমণও আরও সাহসী হয়ে ওঠে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই আক্রমণের জবাবে গ্রামবাসীদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয় এবং রাজাকারদের সাথে স্থানীয় লোকজনকে হত্যা করে। ততক্ষণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়তে শুরু করেছে, তারা আর সহজে তাদের ঘাঁটি থেকে সরে যেতে রাজি ছিল না।
বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে যায় যে, পাকিস্তান কোনো সমাধান খুঁজে না পেয়ে ডিসেম্বরের ৩ তারিখে ভারতে হামলা চালায়। পাকিস্তানের উদ্দেশ্য ছিল একটি আকস্মিক আক্রমণ চালানো এবং ভারতীয় বিমান বাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে পঙ্গু করে দেওয়া, কিন্তু তা করতে ব্যর্থ হয়। ভারত অবিলম্বে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং বাংলাদেশ লিবারেশন আর্মির সাথে মিলিত হয়ে তার সেনাবাহিনী নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
বাংলাদেশে পাকিস্তানের পাঁচটি পদাতিক ডিভিশন ছিল। যুদ্ধের প্রচলিত নিয়ম অনুসারে, আক্রমণের জন্য তিনগুণ বেশি, ১৫ ডিভিশনের সৈন্য নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু ভারতীয়রা মাত্র আটটি ডিভিশন দিয়ে যুদ্ধ শুরু করার সাহস পেয়েছিল। কারণ তাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বাহিনী ছিল। সেই মুক্তিযোদ্ধারা এরই মধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সম্পূর্ণরূপে অচল রাখতে সক্ষম হন। এ যুদ্ধে শুধু মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন না, দেশের সাধারণ মানুষও ছিলেন যৌথ বাহিনীর সঙ্গে।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে মাত্র ১৩ দিন চলছিল। প্রথম দিকে বিমানবন্দরে বোমা হামলার পর পাকিস্তান বিমান বাহিনীর সব পাইলট পাকিস্তানে পালিয়ে যায়। সমুদ্রে বেশ কয়েকটি পাকিস্তানি যুদ্ধজাহাজ ডুবিয়ে দেওয়ার পর, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে কেবল তার স্থল বাহিনী অবশিষ্ট ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা এবং ভারতীয় সেনারা একটি সত্যিকারের যুদ্ধে কীভাবে পারফরম্যান্স করবে তা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল, কারণ তারা নিরীহ মানুষকে হত্যা করতে অত্যন্ত পারদর্শী ছিল।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পাকিস্তানের ঘাঁটি একের পর এক পতন হতে থাকে। তারা কোনোরকমে কয়েক জায়গায় মাটি কামড়ে শেষ করেছে। ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী তাদের পাশ কাটিয়ে অবিশ্বাস্য গতিতে ঢাকার কাছে হাজির হয়। মেঘনা নদীর ওপর সেতু ছিল না, সাধারণ মানুষ তাদের ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নৌকায় করে সেনাবাহিনীকে পার করে দিয়েছে! ঢাকায় জেনারেল নিয়াজী এবং তার জেনারেলরা বাংলাদেশে যুদ্ধে টিকে থাকার জন্য যে দুটি জিনিসের উপর নির্ভর করছিলেন তা ছিল একেবারেই আলাদা।
প্রথমত, তারা বিশ্বাস করেছিল যে, পশ্চিম পাকিস্তান যুদ্ধে তারা ভারতকে এমনভাবে পরাস্ত করবে যে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় বাহিনী প্রত্যাহার ছাড়া আর কোনো আন্দোলন থাকবে না। দ্বিতীয়ত, চীনের সৈন্যরা উত্তর দিক থেকে আসবে এবং আমেরিকান সৈন্যরা দক্ষিণ থেকে তাদের যুদ্ধে সাহায্য করবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, তাদের দুজনের ধারণাই ছিল সম্পূর্ণ ভুল। পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্তে পাকিস্তানিরা অত্যন্ত দুর্দশাগ্রস্ত ছিল এবং চীন বা আমেরিকান সৈন্যরা তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি!
আত্মসমর্পণঃ মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সৈন্যরা ঢাকা ঘিরে ফেলে এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানায়। গভর্নর হাউসে বোমা হামলার কারণে গভর্নর মালেক ও তার মন্ত্রীরা পদত্যাগ করেন এবং হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (বর্তমানে শেরাটন) আশ্রয় নেন। ভারতীয় বিমান বাহিনী ঢাকায় সেনাবাহিনীর উপর লক্ষ লক্ষ লিফলেট ফেলে বলেছিল, 'মুত্তি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার আগে আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করুন'।
ঢাকায় 'সর্বশক্তিমান' পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তখন আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেয়। আত্মসমর্পণ দলিলে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ নেতৃত্বের কাছে আত্মসমর্পণ দেখে পাকিস্তানের একজন জেনারেল একবার ক্ষীণভাবে সেখান থেকে বাংলাদেশের নাম মুছে ফেলার প্রস্তাব দিলেও তার কথায় কেউ কর্ণপাত করেনি, ইতিহাসের সত্যকে অস্বীকার করার উপায় নেই!
১৬ ডিসেম্বর বিকেলে হাজারো মানুষের সামনে জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণ করে মাথা নত করে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি থেকে বিদায়ের দলিলে স্বাক্ষর করেন। যে বিজয়ের জন্য এদেশের মানুষ দীর্ঘ ৯ মাস অপেক্ষায় ছিল, সেই বিজয় এসেছে এদেশে স্বজন হারানো সাত কোটি মানুষের হাতে। এটি ছিল ২২ ডিসেম্বর যখন বাংলাদেশের অন্যান্য অংশে সমস্ত পাকিস্তানি সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছিল।
১৯৭১ সালের যুদ্ধে বাংলাদেশকে সাহায্য করে কোন দেশ
আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে। অন্যদিকে, যখন ভারত বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত গঠন এবং সামরিক সহায়তা নিয়ে এগিয়ে এসেছিল, তখন ভারতকে সমর্থন করেছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। যার বৃহত্তম এবং প্রভাবশালী অংশ এখন রাশিয়া।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কতদিন স্থায়ী ছিল
বাঙালির অসীম সাহসের ফলে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। আর দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ৯ মাস স্থায়ী ছিল।
শেষ কথা - ২৬ মার্চ কি দিবস
প্রিয় পাঠক, আমরা ২৬ শে মার্চ স্বাধীনতা দিবস, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং সংগ্রামের বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধে যারা জীবন দিয়েছে তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। এবং যে উদ্দেশ্যে স্বাধীনতা লাভ হয়েছে তার মান রাখতে আমরা সর্বদা চেষ্টা করবো। আশা করছি, নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে জানবে।
ড্রিমসসেফ আইটিির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url