পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন

সিলেটের ৮টি দর্শনীয় স্থানগুলোআজকে আমরা বাংলাদেশের প্রাচীন ইতিহাসের অন্যতম নিদর্শন পাহাড় বৌদ্ধবিহার এর সঠিক ইতিহাস নিয়ে লেখা আমাদের আজকের আর্টিকেল। ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের অনেকের মধ্যে জানার ইচ্ছা বা পড়ার আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে তাদের জন্য আমাদের নওগাঁর জেলার পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার এর আবিষ্কার, কি কি রয়েছে তা বিস্তারিতবিষয়ে তুলে ধরা।
পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের ইতিহাস সম্পর্কে  বিস্তারিত জানুন
পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের ইতিহাস সম্পর্কে সঠিক ভাবে জানতে এই আর্টিকেলটি খুব মনোযোগ সহকারে পড়ুন। নিচে আপনাদের জন্য পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের ইতিহাস তুলে ধরা হল।

পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার কে আবিষ্কার করেন

ইংরেজরা যখন ভারতীয় উপমহাদেশে আসে তখন তারা সকল স্থানে জরিপ করার কার্যক্রম শুরু করেন। বুকানন হ্যামিলটন পূর্ব ভারতে জরিপ কাজ পরিচালনা করেন। এবং তিনি (১৮০৭-১৮১২) খ্রিস্টাব্দে এই সময়ের মধ্যে প্রত্নতান্ত্রিক পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার প্রথম পরিদর্শন করেন। এরপর ওয়েস্টম্যাকট পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার পরিদর্শনে আসেন। এরপর তাদের অভিজ্ঞতা পত্রিকা প্রকাশ পায় এবং পত্রিকায় প্রকাশ পাওয়ার সূত্র ধরেই,

স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে এই প্রত্নতান্ত্রিক পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার পরিদর্শন করেন। স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম পরিদর্শন শেষে জায়গাটি খনন করার জন্য ব্যাপক আগ্রহ প্রকাশ করেন। ওই সময় বলিহারের জমিদার তদানিন্তন ছিল এই জমির মালিক সে স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম কে কাজ করতে বাধা দেন। পরবর্তীতে তিনি বিহার এলাকার কিছু অংশ পুরাকীর্তির কেন্দ্রীয় ঢিবির উপরের ভাগের কিছু অংশ খনন কাজ করেই সমাপ্তি দেন।

এই খনন কাজের সময়ই কেন্দ্রীয় ঢিবির অংশের চারিদিকে উদগত অংশ বিশিষ্ট একটি বর্গাকার ইমারত আবিষ্কার করে যার দৈর্ঘ্য ছিল ২২ ফুট। অবশেষে এই স্থান ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে প্রত্নতান্ত্রিক আইনের আওতায় ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে এই স্থান সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষিত হয়। ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা দেন।

পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারে কি কি রয়েছ

পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারে রয়েছে ১৭৭ টি ঘর জানা যায় এই ঘরগুলোতে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বাস করতেন। বিহারের অন্তবর্তী স্থানের উন্মুক্ত চত্বরের মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে কেন্দ্রীয় মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। বিহারের মধ্যবর্তী উন্মুক্ত অঙ্গনে ইমারতের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। উন্মুক্ত অঙ্গনের দক্ষিণ পূর্ব অংশে ভোজন ও রন্ধনশালা রয়েছে। এই স্থাপনা দুটির মাঝে একটি নর্দমা আছে এর কাছে একসাথে তিনটি কূপ রয়েছে।

এ ছাড়াও বিক্ষিপ্তভাবে পাওয়া যায় নিবেদন স্তুপ,প্রশাসনিক ভবন,রান্নাঘর,ভোজন শালা,কেন্দ্রীয় মন্দিরের প্রতিকৃতি। বিহারের বাইরের অবস্থিত স্থাপনা স্নানাগার ও শৌচাগার। বিহারের দক্ষিণে অবস্থিত একটি মঞ্চে অনেকগুলো স্নানাগার ও শৌচাগার নির্মাণ করা হয়েছিল। বিহারের দক্ষিণে - পূর্বকোণ থেকে প্রাচীরের বাহিরে ঘাট আছে । এই ঘাটটিকে সন্ধ্যাবতির ঘাট বলা হয়।

রাজা মৈদলনের কন্যা সন্ধ্যাবতী এই ঘাটে নিয়মিত গোসল করতেন। বিহারের পাশ দিয়ে একটি নদী প্রবাহিত ছিল। এই সন্ধ্যাবতীর ঘাট থেকে ১২ মিটার পশ্চিমে পূর্বমুখী প্রাচীরের বাহিরে একটি মন্দির রয়েছে। এই মন্দিরের দক্ষিণ দেয়ালে বৌদ্ধ দেবীর পদ্মপাণির মূর্তি আছে। এটাকে মূলত স্থানীয় ভাবে বলা হয় গন্ধেশ্বরী মন্দির। এছারাও রয়েছে সত্যপীরের ভিটা যা পাহাড়পুর বিহার থেকে ৩৬৫ মিঃ পূর্বে অবস্থিত।

এই ভিটাই তারা মন্দিরসহ বিভিন্ন আকার ও আয়তনের অনেকগুলো স্তূপের ধ্বংসাবশেষ বিদ্যমান রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রত্নতান্ত্রিক বিভাগ একটি জাদুঘর,একটি রেস্ট হাউজ ও কয়েকটি প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ করেছেন।

জাদুঘরে সংরক্ষিত উল্লেখ্যযোগ্য মূর্তি সমূহ,

  • বেলে পাথরের চামুন্ডা মূর্তি
  • বেলে পাথরের কীর্তি মূর্তি
  • পাথরের দণ্ডায়মান শীতলা মূর্তি
  • কৃষ্ণ পাথরের বিষ্ণুর খণ্ডাংশ
  • দুবলহাটির মহারানীর তৈলচিত্র
  • হরগৌরীর ক্ষতিগ্রস্ত মূর্তি
  • কৃষ্ণ পাথরের উমা মূর্তি
  • উষ্ণ পাথরের বিষ্ণু মূর্তি
  • পাথরের লক্ষ্মী নবায়নের ভগ্ন মূর্তি
  • নন্দী মূর্তি
  • সূর্য মূর্তি

পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন

পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারকে সোমপুর বিহার বা সোমপুর মহাবিহার যে নামেই ডাকুন না কেন বর্তমানে এটি ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার। প্রিয় পাঠক,এবার চলুন পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের ইতিহাস সম্পর্কে সঠিক তথ্য জেনে নেই।হিউহেন সাং সপ্তম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পুন্ড্রবর্ধনে আসেন। কিন্তু তার বিস্তারিত বিবরণে সোমপুর বিহার বা মন্দিরের কোন উল্লেখ ছিলনা। গোপালের পুত্র পাল বংশের দ্বিতীয় রাজা শ্রী ধর্মপাল (৭৮১ - ৮২২) খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সিংহাসন আহরণ করেন এবং দীর্ঘ সময় ধরে তা শাসন করেন।

এই রাজ্যটিকে বাংলা বিহার ছাড়িয়ে পাকিস্থানের উত্তর - পশ্চিম সিমান্তের গান্ধার পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেন। সম্রাট ধর্মপাল ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান বৌদ্ধ এবং তিনিই বিক্রমশীলা ও পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার বা সোমপুর বিহার প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু অন্য মতে দেখা যায়,বিখ্যাত তিব্বতীয় ইতিহাস গ্রন্থ "পাক সাম জোন ঝাং" এর লেখক অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে ধর্মপালের পুত্র দেবপাল (৮১০-৮৫০) খ্রিষ্টাব্দ সোমপুরে নির্মিত বিশাল বিহার ও সুউচ্চ মন্দিরের কথা উল্লেখ করেছেন।

এই সময় সোমপুর বিহারের ভিক্ষুরা নালন্দা,বুদ্ধগয়া ভারতীয় বিভিন্ন বৌদ্ধ তীর্থস্থানে অর্থ ও ধনরত্ন দান করতেন বলে বিভিন্ন লিপিবদ্ধে উল্লেখ করা আছে যা ১০-১১শ শতাব্দীতে সমৃদ্ধশীল অবস্থার ইঙ্গিত বহন করে। এছাড়াও নবম শতাব্দী পর্যন্ত পাল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় সোমপুর বিহার ছাড়াও অগ্রপুর (বর্তমান রাজশাহীর অগ্রাদ্বিগুণ),উস্মপুর,গোটপুর,এতপুর ও জগদ্দল যা বর্তমান (রাজশাহীর জগদল) বিহারের উল্লেখ পাওয়া যায়। নবম শতাব্দীর শেষের দিকে গুর্জর রাজ প্রথম ভোজ ও মহেন্দ্র পাল,পাল সাম্রাজ্যের ক্ষতিসাধন করেন।

এরপর দশম শতাব্দীর শেষ ভাগে পাল বংশীয় রাজা মহীপাল (৯৯৫-১০৪৩) খ্রিষ্টাব্দ সাম্রাজ্যে পুনরায় উদ্ধার করেন এবংসোমপুর বিহার মেরামত করেন। কিন্তু আবার পাল বংশের পতন হয় যখন মহীপাল ও তার পুত্র নয়াপালের মৃত্যু হয়। এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে মধ্য ভারতের চেদীরাজ কর্ণ,চুলরাজ রাজেন্দ্র ও দিব্বো নামের কৈবর্ত সামন্ত নরপতি বারবার বরেন্দ্রভূমি আক্রমণ করেন। এ সময় আক্রমণের জন্যই সম্ভবত নালান্দায় পাহাড়পুর মন্দির ও বিহারের ধ্বংস হয়।

পাল বংশীয় রামপাল হিতৃরাজ ১১ শতাব্দীতে পুনরুদ্ধার করেন। দক্ষিনাত্তর কর্ণাট থেকে আগত সেন রাজারা ১২ শতাব্দীতে বাংলা দখল করেন। এতে করে তাদের নিকট রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা হারায়।এ সময় শেষবারের মতো সোমপুরের পতন শুরু হয়। ইখতিয়ার উদ্দিন মুহুম্মদ -বিন -বখতিয়ার খিলজী ১৩ শতাব্দীর শুরুতে বাংলায় আক্রমণ করে উত্তরবঙ্গ দখল করেন। এভাবেই বৌদ্ধদের এই বিহার ও মন্দির সম্পূর্ণরুপে ধ্বংস হয়ে যায়।
এই বিহার ৩০০ বছর ধরে বৌদ্ধদের বিখ্যাত ধর্মচর্চা কেন্দ্র ছিল। শুধু উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকেই নয়,চীন,তিব্বত,মায়ানমার,মালয়েশিয়া,ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশের বৌদ্ধরা এখানে ধর্মচর্চা ও ধর্ম জ্ঞান অর্জন করতে আসতেন।

পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার পূর্বে কি নামে পরিচিত ছিল

পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারটি পূর্বে সোমপুর বিহার নামে পরিচিত ছিল। প্রতিষ্ঠাকালে এর পুরো নাম ছিল শ্রী - সোমপুর - শ্রী - ধর্মপালদের - মহাবিহার - ভিক্ষু সংঘ যা খনন কালে জানা যায় প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে যেভাবে সিলগুলিতে লেখা ছিল তা হলোঃ শ্রীসোমপুরে - শ্রী - ধর্মপালদেব - মহাবিহারিয়ার্য - ভিক্ষু - সংঘস্য।পালবংশের দ্বিতীয় শাসক সোমপুর বিহারটি নির্মাণ করেন। এবং স্যার আলেকজেন্ডার কানিংহাম খনন কাজের মাধ্যমে সোমপুর বিহারটি আবিষ্কার করেন।

পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার কোন জেলায় অবস্থিত

বর্তমান মহাস্থানগড় যা পূর্বে ছিল পুন্ড্র বর্ধনের রাজধানী পুন্ড্রনগর এবং অপর শহর কোটিবর্ষ যা বর্তমান বানগর এর মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত ছিল সোমপুর বিহার। এর ধ্বংসাবশেষটি বাংলাদেশের বর্তমান রাজশাহী বিভাগের নওগাঁ জেলার বদলগাছি উপজেলার পাহাড়পুর গ্রামে অন্তভুক্ত। অপর দিকে জয়পুরহাট জেলার জামালপুর রেলস্টেশন থেকে এর দূরত্ব মাত্র পাঁচ কিলোমিটার।

পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারে কিভাবে যাবেন

কিভাবে খুব সহজে পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারে যাবেন চলুন জেনে নেওয়া যাক। বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে নাওগাঁ জেলার বালুডাঙ্গা বাস টার্মিনালে এসে সরাসরি বাসযোগে আপনার গন্তব্য ঐতিহাসিক পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের যেতে পারবেন। বালুডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড হতে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের দূরত্ব আনুমানিক ৩২ কিলোমিটার এবং বাস ভাড়া ৪০-৫০ টাকা।
অপরদিকে দেশের যেকোনো প্রান্ত হতে জয়পুরহাট শহরে এসে বাস অথবা সিএনজি অটোরিকশা নিয়েও পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারে আসতে পারবেন। জয়পুরহাট থেকে এর দূরত্ব ১৩ কিলোমিটার। এছাড়াও ট্রেন যোগে জামালপুর স্টেশনে নামলে এখান থেকে ভ্যান অথবা অটো রিক্সা নিয়েও পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের আসতে পারবেন। এই জামালপুর স্টেশন হতে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের দূরত্ব ৫ কিলোমিটার।

শেষ কথা

আমাদের পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার নওগাঁ জেলায় অবস্থিত। আপনারা যারা এই সোমপুর বিহার সম্পর্কে জেনেছেন বা সোশ্যাল মিডিয়া কোন ছবিতে দেখেছেন মনের মধ্যে দেখার আগ্রহ জাগলে ঘুরে আসুন নতুন সংস্করণে এবং সংরক্ষণে এখনো ইতিহাস দাঁড়িয়ে আছে আমাদের পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার। যদি পরবর্তীতে আপনারদের কোন বিষয়ে জানার আগ্রহ থাকলে অবশ্যই ড্রিমসসেফ ওয়েবসাইটের সাথেই থাকবেন ধন্যবাদ সবাইকে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

ড্রিমসসেফ আইটিির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url